প্রারম্ভিকা
বাউল গান বাংলাদেশের ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতীক। এই গানের ধারা দেশের গ্রামবাংলার সংস্কৃতিকে বহন করে চলেছে যুগের পর যুগ। সেই ধারার অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন বাউল শফিক উদ্দিন। তাঁর গানের মাধ্যমে বাউলিয়ানা ও পল্লীগীতির মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে, যা তাকে সিলেটের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
শৈশব ও সংগীতের প্রতি আকর্ষণ
বাউল শফিক উদ্দিনের পুরো নাম মোঃ শফিকুর রহমান। তিনি সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার আমতৈল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম তেরাব আলী ছিলেন এক নিবেদিত বাউল ভক্ত। বাবার প্রতি মানুষের সম্মান ও গানের প্রতি তাঁর অনুরাগ শফিক উদ্দিনের মনেও সংগীতের প্রতি ভালোবাসার বীজ বপন করে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ওরস, মাহফিল ও হালতি গানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বাবা থাকাকালীন সময়েই তিনি গোপনে বিভিন্ন গানের আসরে গিয়ে গান শুনতেন।
গানের পথে যাত্রা
শৈশবে স্কুলের পড়াশোনা চলাকালীন তিনি গান গাওয়ার প্রবল আগ্রহ অনুভব করতেন। মাঠে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, এমনকি পড়ার টেবিলেও গান ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। ১৩ বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর জীবন সংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে ওঠে। দুই বছর পর বাধ্য হয়ে পড়াশোনা বন্ধ করে দেন এবং সংগীতকে জীবনের নিত্যসঙ্গী করে নেন।
প্রথম সংগীত শিক্ষা ও ক্যারিয়ারের শুরু
সংগীতে আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি হয় তাঁর ফুফাতো ভাই সাচ্চু মিয়ার হারমোনিয়াম বাজানোর মাধ্যমে। এরপর সিলেটের সিংগেরকাচ এলাকার গীতিকার তৈমুস আলীর অনুপ্রেরণায় ও সহযোগিতায় তাঁর প্রথম গানের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। অ্যালবামের নাম ছিল “ভাটির দেশের নাইয়া”, যেখানে তাঁর গাওয়া জনপ্রিয় গান “ওরে শ্যাম কালিয়া”, “সাজাও বাসর নানা রঙের ফুলে”, “নিশিগত হইলো তুমি আইলায়না” ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
প্রতিযোগিতা ও স্বীকৃতি
২০০১ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি বিশ্বনাথ উপজেলা ভিত্তিক এক গানের প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। এরপর ২০০২ সালে হারমোনিয়াম বাদক মোতাহির ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচিত হন বাংলাদেশের বিখ্যাত বাউল শিল্পী ক্বারী আমীর উদ্দিনের শিষ্য বাউল জুয়েল আহমেদের সঙ্গে। এরপর তাঁর অধীনে গানের তালিম নিতে শুরু করেন।
হারমোনিয়াম ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রে দক্ষতা
বাউল শফিক উদ্দিন শুধুমাত্র একজন বাউল শিল্পী নন, তিনি একজন দক্ষ হারমোনিয়াম বাদকও। গানের পাশাপাশি তবলা ও ঢোল বাজানোতেও রয়েছে তাঁর দক্ষতা, যা তাঁকে একজন সম্পূর্ণ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে গড়ে তুলেছে।
বাংলাদেশ বেতার ও পল্লীগীতি শিল্পী
বাউল শফিক উদ্দিন ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশ বেতার সিলেটে নিয়মিত গান করে আসছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ বেতার সিলেটের প্রথম সারির একজন পল্লীগীতি শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর গানের আবেদন শুধু গ্রামবাংলার মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তিনি দেশের বাইরেও বাউল গানের প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।
জনপ্রিয়তা ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে উপস্থিতি
বর্তমানে বাউল শফিক উদ্দিনের গাওয়া গান ইউটিউব এবং ফেসবুকসহ বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যায়। Hayder Rubel Gallery চ্যানেলে তাঁর অসংখ্য গান রয়েছে, যা বিপুল সংখ্যক দর্শক-শ্রোতার মন জয় করেছে। এছাড়াও তাঁর নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজ রয়েছে, যেখানে নিয়মিত নতুন গান প্রকাশিত হয়।
উপসংহার
বাউল শফিক উদ্দিনের জীবনসংগ্রাম ও সংগীতচর্চা প্রমাণ করে যে সত্যিকারের শিল্পী হতে হলে পরিশ্রম, ধৈর্য এবং আত্মনিবেদন অপরিহার্য। তাঁর গানের মাধ্যমে তিনি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন এবং বাংলাদেশের বাউল সংগীতের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন। ভবিষ্যতে তিনি আরও অসংখ্য সঙ্গীতপ্রেমীর হৃদয় জয় করবেন, এটাই প্রত্যাশা।