দেওয়ান একলিমুর রাজা : তার জন্ম ১৮৮৯ সালের ৫ নভেম্বর বুধবার সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা গ্রামে। তিনি প্রখ্যাত গীতিকার হাসন রাজার তৃতীয় ছেলে। তার মা মোসাম্মৎ সাজেদা বেগম। তাঁর পূর্বপুরুষেরা হিন্দু ছিলেন। তাঁর নানার বাড়ি বর্তমান ভারতের করিমগঞ্জ জেলার কুশিয়ারকুল পরগণনার কর্ণমধু গ্রামে । আট বছর বয়সে মন্টুবাবু নামে এক ব্রাহ্মণ শিক্ষকের হাতে তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। মন্টুবাবুর তত্ত্বাবধানে এক বছর পড়াশোনার পর তাঁকে সুনামগঞ্জ জুবিলি হাই স্কুলে ভর্তি করানো হয়। এরপর তিনি সিলেট গভর্নমেন্ট হাই স্কুল ছাড়াও ঢাকা ও কলকাতার স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। তবে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার আগেই তিনি গার্হস্থ্য জীবনে প্রবেশ করে বাবার জমিদারি দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত হন জমিদারি দেখার পাশাপাশি তিনি বাবার মতো পল্লিগান রচনায় মনোনিবেশ করেন । তাঁর লেখা প্রবাসী, ভারতী, ভারতবর্ষ, নওরোজ, অভিযান, আল ইসলাহ-সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। লিখেছেন অন্তত ২৫০ গান, ৩০০ কবিতা, ৯টি উপন্যাস (গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত), ১২টি প্রবন্ধ এবং ৪টি গল্প। তাঁর প্রকাশিত গানের সংকলনগুলো হচ্ছে : প্রাণের কথা গানে (১৯৪৯) ও গীতিমেখলা (১৯৬৩)। আমার সাহিত্যিক জীবনের অভিজ্ঞতা শীর্ষক তাঁর একটি অপ্রকাশিত আত্মজৈবনিক গ্রন্থ রয়েছে। প্রখ্যাত শিল্পী আব্বাসউদ্দিন, নির্মলেন্দু চৌধুরী, সুরসাগর প্রাণেশ দাস, উজির মিয়া, অন্নদা, বিদিত লাল দাশ, আরতি ধর প্রমুখ তাঁর গানে সুর করেছেন । পূর্বপুরুষদের মতোই তিনি কয়েকটি বিয়ে করেছিলেন। ১৯২৮ সালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) সিলেট সফরে এলে তাঁর সম্মানে দেওয়ান একলিমুর রাজা চা-চক্রের আয়োজন করেছিলেন। ১৯২৯ সালে একলিমুর রাজা ভারতের শিলং শহরের ময়ূরভঞ্জের মহারানির বাড়িতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। একই বছর ইংরেজ সরকার নিযুক্ত আসামের গভর্নর লর্ড আর উইন তাঁকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এ ছাড়া ভারতের নবদ্বীপের সারস্বত সমাজ তাঁকে ‘কাব্যবিশারদ’ উপাধি দেয়। ১৯৩৭ সালের ৩ অক্টোবর পল্লিকবি জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬) সিলেটে এলে তাঁর সঙ্গেও একলিমুরের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। তিনি একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদও ছিলেন। ১৯২৬ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত সিলেট লোকাল বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ১৯৩৬ সালে সিলেটে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ (কেমুসাস) গঠিত হওয়ার পর, তিনি সেটির কার্যকরী কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তৎকালীন আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও তিনি দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আসাম টেক্সট বুক কমিটির সদস্যের পাশাপাশি ‘মাস লিটারারি ক্যাম্পেন’ ও ‘ঋণ শালিশি বোর্ড’-এর অনারারি পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৪ সালের ১৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যের পোর্টসসাউথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
দেওয়ান একলিমুর রাজা
Category: বাউল বৃত্তান্ত